ভালোবাসার সাতকাহন (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-১৩)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২৬ অক্টোবর, ২০১৪, ০৪:৫১:৪৮ বিকাল
গাড়ি থেকে নেমে সামিয়া বাচ্চাটাকে বাচ্চার নতুন বাবার হাতে দিল। বাচ্চাটাকে অনভ্যস্ত হাতে একটুক্ষণ রেখে একবার মুখটা দেখেই সামিয়ার হাতে দিয়ে দিলেন মিনার মাহমুদ।
রেখা এগিয়ে এসে বাচ্চাটাকে নিয়ে ফেলল। ডায়াপারের উপরে স্কার্টের ডিজাইনে প্যান্ট আর নরম সাদা পাতলা লিনেনের কোমর পর্যন্ত জামা পরা ফর্সা হাত পায়ের ছোট্ট মেয়েবাবুটার গালে লালচে আভা! কি সুন্দর করে টুকটুকে লাল ঠোঁট উল্টে অভিমানী চেহারা করে কাঁদছে বাচ্চাটা! 'কোল বদল বুঝেছে!' অবাক খুশিতে বাচ্চাটাকে দুই হাতে ধরে নিয়ে নিজের মুখের সামনে ধরল সে। বাচ্চাটার চোখে চোখে তাকিয়ে হাসল, ' আমি তোমার আম্মু, বুঝেছ? '
সামিয়া হেসে ফেলল,' নতুন স্টুডেন্টের সাথে পরিচিত হচ্ছিস? '
এক হাতে বাচ্চাটাকে বুকের কাছে ধরে অন্য হাতটা দিয়ে পাশে দাঁড়ানো সামিয়ার এক হাত ধরে রেখা হাসল,' কি সুন্দর, না?' রেখার চোখ থেকে ঝরঝর কান্না ঝরতে লাগল। বন্ধুর আবেগে সামিয়ারও চোখ ভিজে গেল। একটু অন্য কষ্টও লাগছিল। এই কয়দিনে বাচ্চাটাকে নিজের ভেবেছে। অধিকার থাকল না।
সবাই মিলে চার ধাপ চওড়া সিড়ি পার হয়ে বারান্দায় উঠল। মিনার মাহমুদ সবার অলক্ষ্যে বারান্দায় রয়ে গেলেন। বেতের চেয়ারটাতে বসে আকাশের দিকে চেয়ে তার বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল। গভীর থেকে সমুদ্রসমান অসহায়ত্ব নিয়ে অস্ফুট শব্দটা উঠে এল,'মা! '।
...
বিদায় নিতে হবে। সামিয়া ছেলেদের দিকে তাকাল। মুখটা করুণ করে পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছে দুজন। বাচ্চাটার দিক থেকে একবারের জন্যও মুখ ফিরায়নি জমজ দুই ভাই। অবস্থা বুঝে সামিয়া একটু সহজ মুখে হাসল,' বয়েজ, আমরা প্রত্যেক ছুটির দিনে মা'য়িশাকে দেখতে আসব। তাই না? '
ছেলেরা হ্যা বোঝাতে মাথা নাড়ল। চেহারায় কান্না ভাবটা বেচারাদের রয়েই গেল।
সামিয়া বাচ্চার সব জিনিস পত্র রেখাকে বুঝিয়ে দিতে বসল। রেখা হাসল,' আমার কেনার জন্য মার্কেটে তো আর কিচ্ছু নাই! '
অনেক রাত পর্যন্ত ছেলেরা বাসায় যেতে রাজী হল না। ঘুমে চোখ লাল হয়ে আসার পর চোখ মুছতে মুছতে গাড়িতে উঠল দুই ভাই। হঠাৎ পেয়ে যাওয়া বোনটাকে ফেলে যাওয়ার সময় দুজনই বুঝল, রাজপুত্র যখন তুষারকণাকে বিয়ে করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সাত বামনের কত কষ্ট হচ্ছিল। সব কষ্ট ছোট্ট মানুষ দুটো হাত ধরাধরি করে নি:শব্দে সইল। রেখা খালামণির একটাও বাবু নাই। সেজন্য ওর অনেক কষ্ট - দুই ভাইই জানে।
লেখক খুব ভোরে উঠেছেন আজ। বাচ্চাটা ঘর অন্ধকার হলেই কাঁদছিল। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার না হলে তিনি ঘুমাতে পারেন না। রাত জাগার অভ্যাস তার আছে। খুব সমস্যা হয়নি। কষ্ট দিয়েছে অযাচিত ভাবনা।
রাতটা কাটিয়েছেন রেখা আর রেখার বুকের কাছে ছোট বাচ্চাটাকে দেখে। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে দুজন। এই দৃশ্য দেখে ঘন্টার পর ঘন্টা ভাবলেন। নিজের কাছে নিজে লজ্জা পেলেন। রেখার আবেগের প্রায় কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না। বরং সুন্দর কিছু দেখার যে সুখ সেইটুকুরও নাগাল পাচ্ছেন না। শিশুতো এমনিতেই কিছু আদর পায়। দীর্ঘশ্বাস ছাড়া সারাটা রাত ভরে বাচ্চাটাকে তিনি কিছুই দিতে পারলেন না। কেন এমন ভার ভার লাগছে? নিজের শরীর, নিজের বংশধারার নয় বলে! নিজেকে ছোট মনে হল তার। রেখা বুঝতে পারলে কী ভাববে?
'নিজের হলেই কি নিজের হত? ' নিজের কাছে নিজের করা প্রশ্নটা তীরের মত বিঁধল তার মনে। বাবা মায়ের জন্য তিনি কী করেছেন?
কত বছর হয় - এক বেলা ভাত একসাথে বসে খাওয়া হয়নি! মাসের শুরুতে ছাড়াও যখন তখন দরকার জানলেই টাকা পাঠিয়েছেন। কিন্তু –
কেন এমন হল? কেন কাউকে ক্ষমা করা এত কঠিন হয়? যাদের কাছ থেকে জন্ম, যাদের হাতে বেড়ে ওঠা, জীবন চেনা - কেন সেই মানুষগুলিকে কাছে রাখা গেল না!
নিজের শিক্ষা , আত্মকেন্দ্রিকতা, প্রতিষ্ঠা,খ্যাতি - সব কিছুকে অপরাধী মনে হল তার। আর অপরাধী ভাগ্য।
দুর্ভাগ্য।
লেখকের মনের চোখে সারি সারি মুখ... রাস্তায় ঘাটে আশে পাশে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের মুখ... তৃপ্ত কিম্বা রাগী বাবার মুখ...
শেষ পর্যন্ত ভাবনায় নিজের মায়ের মুখটা স্থির হল।
আবছা মনে পড়ল, ' বাবা, মেয়েটার দোষ আছে নিশ্চয়! ' রেখার বিবর্ণ চেহারা। অথচ দোষ তার নিজের! রেখা সব জেনেও কিছুতেই এই কথা কারো কানে তুলতে দিতে চায়নি। শুধু মেয়েটাকে সবাই মিলে এত কষ্ট না দিলে হয়ত মিনারও বলত না। এইসব মানুষের নাকের জন্য আরেকজন মানুষের বেডরুম পর্যন্ত জায়গা কেন লাগে! বিতৃষ্ণ মন বিষিয়ে ওঠে তার।
আবার ভাবে - এত ডাক্তার, চিকিৎসা - কোন কাজে আসেনি। গ্রাম্য সমাজের সমস্ত অভিশাপে ডুবে ভেসে বেঁচে থাকা পছন্দ করেছিল বলে যাদেরকে একদিন দুরে সরিয়েছিলেন লেখক- বিবেকের সামনে দাঁড়িয়ে আজ তাদের চাইতে নিজেকেই বেশি দোষী পেলেন। শহরের সভ্যতার আড়ালে অসভ্য জীবনের কতটুকু থেকে দূরে ছিলেন তিনি?
মা! বাবা!
শুধু মা বাবা বলেও কি তাদের দোষটুকু ভুলে যাওয়া যেত না?
সে যদি ক্ষমা করে, সে কি স্রষ্টার ক্ষমা পাবে! পাবে না?
লেখক মনস্থির করলেন। রেখা আর বাবুকে নিয়ে গ্রামে একটা দিন কাটিয়ে আসবেন।
... ... ...
রেখা নাশতার টেবিল সাজিয়ে স্বামীকে ডাকতে এসে দেখল দুই হাতে বাচ্চাটাকে নিয়ে পুতুলের মত মুখটা পরম আদরে নিজের গালে চেপে চোখ বুজে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
মৃদু হাসল সে। স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলল।
মিনার মাহমুদ চোখ খুললেন,। হেসে বললেন,
: চল,বাবুকে নিয়ে মা বাবাকে দেখিয়ে আনি ।
রেখা হেসে সায় দিল,
: 'আচ্ছা '
বাচ্চাটা তুলতুলে হাতে লেখকের গাল ছুঁয়ে গেল। মিনার মাহমুদ ছোট ছোট আংগুলগুলি ধরে নিজের পিতৃত্বকে অনুভব করতে লাগলেন।
মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,' তুমি আমার নতুন মা? '
... … …
লতার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয়। বড় আপা,মেজ আপা, ভাইয়া, ও নিজে, ছোট বোন পরী আর মা।
বাবা কিম্বা বাবার স্মৃতি - কিছুই নেই। ছোট বেলাটা মামাদের কাছে কেটেছে ওর আর ওর পরিবারের। আশ্রিতদের যেমন কাটে।
অসময়ে কলেজ ছাড়ার পর মা আর ছোট বোনকে নিয়ে ক' বছর ধরে এই শহরের এক ঘিঞ্জি এলাকার একটা পুরানা বিল্ডিং এর তিনতলায় থাকে। বোন ভার্সিটিতে পড়ে। মা অসুস্থ। লতা একটা প্রাইভেট হাসপাতালের রিসেপশনিস্ট।
অন্য সবাই একেক জেলায় নিজের সংসারে।
দুটো ছোট রুম। এক রুম লতার। অন্যটাতে মা আর ছোট বোন পরী। দুই রুমে দুটো জানালা। এক বাথ।
এই বাড়িটার দোতলায় সিড়ির পাশে সব ভাড়াটের জন্য কমন একটা খোলা বাথরুম। সকালে সাধারণত ছেলেরা গোসলের জন্য ব্যবহার করে। এক সারিতে চারটা ট্যাপ। সকাল আটটার পর কাজের লোকেরা দুনিয়ার ধোয়া ধুয়ি আর বদনাম এখানেই করে থাকে। ফলটা হয়, কার ঘরে কে কী খায়, কী পরে, কী ফেলে দেয়, কে আসে, কে যায় মোটামুটি সবাই জানে। পাশের ফ্যামিলির সাথে শেয়ারে টানা একটা বারান্দা। সিড়ির পাশের ফ্ল্যাট লতাদের।
লতা নিজের রুমে খোলা জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। বিকাল ও চলে যাচ্ছে।
' সময় ও নদীর স্রোত কাহারো জন্য অপেক্ষা করে না'। ছোট্ট একটা নি:শ্বাস ফেলল সে। 'কিছুই কারো জন্য অপেক্ষা করে না।' আকাশে মেঘের কিনারায় ঘোমটার মত সোনালী আলো। খোলা জানালার আয়নায় নিজেকে দেখল। অনবগুন্ঠিতা! ' তুমি অকুন্ঠিতা!' স্বনামধন্য লেখক, আবৃত্তিকার মিনার মাহমুদের ভারী স্বর স্মৃতিতে প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে গেল।
মৃদু বিষন্ন হাসি ফুটল এলোমেলো খোলাচুল লতার আনমনা মুখে! সে যা হারিয়েছে তা নিয়ে তার দু:খ হচ্ছিল না, যে মানুষটাকে ভালবেসে এই ক্ষতি সারাজীবনের জন্য মাথায় তুলে নিল সে সেই ক্ষতির পরিমাণ, কিম্বা সেই ক্ষতিতে লতার নিজেকে ফেলার, সব মেনে নেবার কারণ কি বোঝে ? সে তাকে কী চোখে দেখছে? লতা কাঁদছিল। সে জানে সে একা হয়ে যাচ্ছে!
পরী আর মায়ের আঞ্চলিক ভাষায় বলা শব্দগুলি রান্নাঘর থেকে স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে লতার কানে আসছিল। ঘর। নিজের মত থাকার জায়গা। নিরাপত্তাহীনতা, অপমানের পৃথিবীতে শান্তির একটুখানি জায়গা।
সকালে পার্লার থেকে লেটেস্ট ফ্যাশনে ছাঁটা ছোট, রেশমী চুলে বাতাস খেলছিল। চোখে মুখে উড়ে এসে পড়ছে। জানালার গ্রিলের বাইরে নিচে তাকালো লতা। বিল্ডিং এর পিছনের দুটো প্লটের ওপাশে রাস্তায় ব্যস্ত মানুষ গাড়ি ট্যাক্সি রিক্সা দোকান পাট।
মা পিঠা বানাচ্ছে। ঘর পার হয়ে ঘ্রাণ জানালার বাইরে চলে যাচ্ছে। বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসছে।
গ্যাসের চুলার সামনে দাঁড়ানো মায়ের কাছ ঘেঁষে দাড়িয়ে আঁচল টেনে ধরল লতা। মা মুখ ফিরিয়ে দেখে হাসলেন, ' পাগল!'
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১৭০৯ বার পঠিত, ২৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
খেতে ইচ্ছে করছে খুব।
লেখা ভালো হইছে।
হ্যা, পিঠা খাবার সময় এসে গেছে। কিন্তু আপনার এই ইচ্ছেটা এখান থেকে পুরণ করতে পারছি না বলে কিছুটা দুঃখ পেলাম।
ভালোলাগার অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগার অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ । শুভকামনা রইলো।
আর পিঠার ছবি দিয়ে দিচ্ছি নীচের কমেন্টে।
ধন্যবাদ।
অপেক্ষা মধুর হয়, তাই আপনার কষ্ট নিশ্চয়ই হবে না।
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শুভকামনা রইলো।
সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ভালোলাগার অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
শুভকামনা রইলো।
কোন বিষয়/কাউকে ভাল লাগা-ভালবাসা বা শ্রদ্ধা আমি সঠিকা ভাবে বুঝাতে পারি কখনো,
সাদা-মাটা ভাবেই বলছি... ভালো লাগলো, অনেক ধন্যবাদ।
ভাল থাকার কামনা।
ভালোলাগার অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক শুভেচ্ছা।
আপুজ্বীদ্বয়ের জন্যেই শুধু!
অধম ভাইয়েরা কী দোষ করল!!
আচ্ছা নিন,নীচের কমেন্টে আরো দিলাম। এগুলো আপনি সহ অণ্য ব্লগার ভাই বোনদের জন্য দিলাম..।
আরো কিছু নিন
বারাকাল্লাহু ফীহ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন